৭ গোলের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে বার্সাকে হারিয়ে ফাইনালে ইন্টার

অসাধারণ! অদ্ভুত! অবিশ্বাস্য! উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সাত গোলের স্মরণীয় একটি ম্যাচ ফুটবলপ্রেমীদের উপহার দিল ঐতিহ্যবাহী দুই দল। বারবার মোড় বদলানো ১২০ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জিতল ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলান। স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনাকে বিদায় করে তারা উঠল ইউরোপের সর্বোচ্চ ক্লাব আসরের ফাইনালে।
মঙ্গলবার রাতে ঘরের মাঠ সান সিরোতে সেমিফাইনালের রোমাঞ্চকর ফিরতি লেগে ৪-৩ গোলে জিতেছে ইন্টার। ফলে দুই লেগ মিলিয়ে ৭-৬ ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে তারা।
ক্যাম্প ন্যুতে প্রথম লেগের মতো এবারও নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয় ৩-৩ সমতায়। প্রথমার্ধে দুই গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধে তেতে ওঠা বার্সার কাছে তিন গোল হজম করে ইন্টার। হান্সি ফ্লিকের শিষ্যদের ফাইনালে ঠাঁই নেওয়া যখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল, তখনই ঘুরে দাঁড়িয়ে সমতা টানে নেরাজ্জুরিরা। এরপর অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের নবম মিনিটে জয়সূচক গোলটি করেন বদলি নামা ইতালিয়ান মিডফিল্ডার দাভিদে ফ্রাত্তেসি।

গোল উৎসবের ম্যাচ হলেও আলাদা করে নজর কাড়েন ইন্টারের গোলরক্ষক ইয়ান সোমার। বার্সার দারুণ সব প্রচেষ্টা রুখে দেন তিনি গোলপোস্টের নিচে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। আগের লেগের মতো এই লেগেও করেন সাতটি সেভ।
বিরতির আগে তিনটি শট লক্ষ্যে রাখতে পারে ইন্টার। এর মধ্যে দুটি থেকেই গোল আদায় করে নেয় তারা। ২১তম মিনিটে লাউতারো মার্তিনেজের গোলে এগিয়ে যায় দলটি।
বার্সার দানি অলমোর অসাবধানতায় বল কেড়ে রক্ষণচেরা পাস দেন ফেদেরিকো দিমার্কো। নিজে শট নেওয়ার সুযোগ থাকলেও ডেনজেল ডামফ্রিস ডি-বক্সে খুঁজে নেন ফাঁকায় থাকা আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারকে। ততক্ষণে গোলপোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন গোলরক্ষক ভয়চেখ স্ট্যান্সনি। একদম খালি থাকা জালে বল পাঠাতে ভুল করেননি আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার।

প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে স্বাগতিকরা। ডি-বক্সে লাউতারোকে ট্যাকল করতে গিয়ে ফাউল করে বসেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার পাউ কুবারসি। ভিএআরের সাহায্য নিয়ে স্পট-কিকের বাঁশি বাজান রেফারি। স্ট্যান্সনিকে উল্টো দিকে ছিটকে গিয়ে ১২ গজ দূর থেকে লক্ষ্যভেদ করেন তুর্কি মিডফিল্ডার হাকান চালহানোলু।
এই অর্ধে কেবল একটি শটই লক্ষ্যে ছিল বার্সেলোনার। ১৫তম মিনিটে পেদ্রির কাছ থেকে বল পেয়ে লামিন ইয়ামালের নেওয়া শট অবশ্য ছিল দুর্বল। তা সহজেই আটকান সোমার।
বিরতির পরও বল দখলে রেখে খেলতে থাকে সফরকারীরা। সেইসঙ্গে ম্যাচে ফিরতে আক্রমণের ধার বাড়ায় তারা। ফল আসতে সময় লাগেনি বেশিক্ষণ। দ্বিতীয়ার্ধের নবম মিনিটে বামপ্রান্ত থেকে জেরার্দ মার্তিনের ক্রসে দুর্দান্ত ভলিতে গোল করেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার এরিক গার্সিয়া।
দ্রুতগতির পাল্টা আক্রমণে এই দুই ফুলব্যাকের সমন্বয়ে ৫৭তম মিনিটে সমতা প্রায় টেনেই ফেলেছিল বার্সা। কিন্তু এই দফায় সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেন গার্সিয়া। মার্তিনের কাছ থেকে বল পেয়ে মাত্র ছয় গজ দূর থেকেও লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি তিনি। সোমার দক্ষতার ছাপ রেখে ফিরিয়ে দেন তার প্রচেষ্টা। হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন গার্সিয়া।
তিন মিনিটের মধ্যেই সমতা ফেরে খেলায়। স্প্যানিশ ডিফেন্ডার মার্তিন আরেকটি বিপজ্জনক ক্রস ফেলেন ডি-বক্সে। ছুটে এসে হেড করে নিশানা ভেদ করেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার অলমো।
৬৯তম মিনিটে বার্সার পক্ষে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন রেফারি। তবে ভিএআরের সাহায্য নিলে দেখা যায়, ইয়ামাল ডি-বক্সের সামান্য বাইরে হেনরিখ মিখিতারিয়ানের ফাউলের শিকার হয়েছিলেন। তাই আগের সিদ্ধান্ত পাল্টে দেওয়া হয় ফ্রি-কিক।
আট মিনিট পর ফের সুইস গোলরক্ষক সোমারকে মঞ্চে আবির্ভূত হতে হয়। দূরের পোস্টে নেওয়া স্প্যানিশ উইঙ্গার ইয়ামালের শট ঝাঁপিয়ে রক্ষা করেন তিনি। তবে মিনিট দশেক পর আর সম্ভব হয়নি। ৮৭তম মিনিটে রাফিনিয়ার গোলে এগিয়ে জয়ের দুয়ারে পৌঁছে যায় বার্সেলোনা। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের প্রথম শট সোমার ঠেকানোর পর আলগা বল দূরের পোস্ট দিয়ে জালে পাঠান তিনি।
এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রাফিনিয়ার এটি ১৩তম গোল। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সেহু গিরাসির সঙ্গে আসরের গোলদাতাদের তালিকায় যৌথভাবে শীর্ষে অবস্থান করছেন তিনি।

যোগ করা পাঁচ মিনিটের দ্বিতীয় মিনিটে বড় বাঁচা বেঁচে যায় ইন্টার। ডানপ্রান্ত থেকে ইয়ামালের শট বাধা পায় পোস্টে। আর পরের মিনিটেই স্বাগতিকরা স্কোরলাইন ৩-৩ করে স্তব্ধ করে দেয় বার্সাকে। দুই লেগেই অসাধারণ পারফর্ম করা ডাচ ডিফেন্ডার ডামফ্রিসের ক্রসে নিশানা ভেদ করেন ফ্রান্সেসকো আচেরবি। জার্সি খুলে বুনো উল্লাসে মাতেন ইতালিয়ান ডিফেন্ডার।
নির্ধারিত সময়ের শেষ মুহূর্তের এই গোলের পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এর আগে যদিও আরেকটি সুযোগ তৈরি করে কাতালনরা। তবে রাফিনিয়ার পাসে ইয়ামালের শট ফাঁকি দিতে পারেনি প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে।
৯৯তম মিনিটে ইন্টারকে এগিয়ে দিয়ে গোটা সান সিরোকে কাঁপিয়ে দেন ফ্রাত্তেসি। মার্কাস থুরাম ডি-বক্সে বল দখলে রেখে বার্সার দুই খেলোয়াড়ের চাপ সামলে ডানপ্রান্ত থেকে খুঁজে নেন বদলি মেহদি তারেমিকে। ইরানি স্ট্রাইকার ছোট পাস বাড়ান আরেক বদলি ফ্রাত্তেসির উদ্দেশ্যে। একটু থেমে বাঁ পায়ের কোণাকুণি শটে পোলিশ গোলরক্ষক স্ট্যান্সনিকে ফাঁকি দেন তিনি। এরপর গ্যালারিতে উপস্থিত ভক্তদের কাছে গিয়ে করেন উদযাপন।

বাকি সময়ে গোল শোধে মরিয়া হয়ে উঠেও পারেনি বার্সা। বদলি নামা রবার্ত লেভানদোভস্কির খুব কাছ থেকে করা হেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ক্রসবারের ওপর দিয়ে। আরও দুবার সোমার প্রতিহত করেন ইয়ামালের প্রচেষ্টা। সব মিলিয়ে গোলমুখে নয়টি শট নিলেও জালের দেখা পাননি তিনি।
২০২২-২৩ মৌসুমে রানার্সআপ হওয়ার পর ফের ইউরোপের সর্বোচ্চ ক্লাব আসরের শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে জায়গা নিয়েছে ইন্টার। আগামী ১ জুন মিউনিখে পিএসজি অথবা আর্সেনালের মুখোমুখি হবে তারা।
হেরে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে বার্সেলোনার ট্রেবল জয়ের সম্ভাবনা। কিছুদিন আগে ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রেতে চ্যাম্পিয়ন হয় কাতালানরা। লা লিগার শিরোপা জয়ের দৌড়েও তারাই ফেভারিট। চার রাউন্ড বাকি থাকতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়ালের চেয়ে ৪ পয়েন্টে এগিয়ে শীর্ষে আছে তারা।
Comments