যারা জীবনের মাধুরী করে গেছেন দান

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।

অল্পসময়ের ব্যবধানে চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সৌমিত্রের মৃত্যু সঙ্গত কারণেই সবার মনে এক বিষাদের আলোড়ন তুলেছে। আর অলোকরঞ্জনের যেন নীরবেই প্রস্থান হলো। কোথাও যেন কোনো ক্রন্দন নেই। সৌমিত্রকে নিয়ে শোকের উপস্থিতি ছিল সর্বত্রই। আর তা হবেই বা না কেন? বিশাল এক ক্যানভাসকে তিনি যে নানাভাবে রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন। বিশেষভাবে সেলুলয়েডে তার সরব, সজীব ও সৃষ্টিময় উপস্থিতি সব বয়সের দর্শকের স্মৃতিতে যে সদা জাগরুক।

কিন্তু, যারা বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলের খোঁজ-খবর রাখেন বা রাখতে ভালোবাসেন, তাদের জন্যে অলোকরঞ্জনের মৃত্যুও যে এক ভীষণ বেদনার। দুই জনের মধ্যে সবচেয়ে মিলের জায়গাটি বোধহয়; বৈদগ্ধ্য আর সৃষ্টির আশ্চর্য সমন্বয় তাদের গোটা জীবনজুড়ে। আর আশ্চর্য এই সমন্বয়ের বীজটি বোধহয় রোপণ হয়েছিল তাদের গড়ে ওঠার সেই সময়টাতে, যে সময়টার বর্ণনা আমরা পাই আরেক সমসাময়িক কবি, নাট্যকার, অনুবাদক এবং বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাবন্ধিক গবেষক শিশিরকুমার দাশের লেখায়—

‘সব মিলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যে আমাদের সকলের জীবনেই তার প্রভাব পড়াটাই ছিলো নিতান্ত স্বাভাবিক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা হত। চারপাশে লাইব্রেরী ছিল স্বর্ণখনি। চারপাশের কাজকর্ম ছিল বিচিত্র। সে সময় যখন অবসর বিনোদনের উপাদান ছিল স্বল্প তখনো আমাদের জগৎ ছিল উৎসাহে, উত্তেজনায়, আনন্দে ভরা। Boredom শব্দটা আমাদের vocabulary-তে ছিলো না।’

পরিশীলিত, মার্জিত, সংস্কৃতিবান ও বিশ্ববীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন দুই জনেই। সৌমিত্রের স্ব-আলোয় উদ্ভাসিত নানামাধ্যমে বিচরণ যেমন ছিল তার একেবারেই নিজস্ব, তেমনি বিদ্যুৎময় শব্দ প্রয়োগ ও আঙ্গিকে অলোকরঞ্জন ছিলেন অনন্য। তার সেই বিদ্যুৎময় শব্দপ্রয়োগের কিছুটা নমুনা আমরা হয়তো তার কবিতার এই কয়েকটি চরণ থেকে পেতে পারি—

‘সব আকাঙ্ক্ষাগুলি

ছাই হয়ে খাবারের

থালা রয়েছে লেগে

বিদীর্ণ এনামেলে।’

বা,

‘নিরালা নিখিল, সব-কিছু দাও,

মৃত্যুর সুরা, জীয়নসুধাও,

আর তারপরে দ্বিগুণ অর্ঘ্য অর্চনা নাও।’

প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিন যথার্থই বলেছেন— ‘কবিতা, প্রবন্ধ ও অনুবাদ— সাহিত্যের এই তিনটি শাখায় তিনি কারুকার্যময় যে-সৌধ নির্মাণ করেছেন, তার তুলনা বুদ্ধদেব বসু ছাড়া আর কারোর সঙ্গে হতে পারে না। যদিও ভাবুকতার মৌলিক দীপ্তিতে তার প্রবন্ধ অনেক বেশি গুরুত্ববহ। অনুবাদে— আমার বিবেচনায়— তিনি আদর্শতম জায়গায় অবস্থান করছেন। আর কবিতায় তিনি পৃথিবীর প্রধান কবিদের গোত্রভুক্ত।’

যৌবন বাউলের কবি নিজস্ব ভুবনে সত্যিই ছিলেন অনন্য। সেই তিনি যখন বলেন— ‘কিন্তু আমি বলতে চাইছি মনন এবং সংবেদন এই দুটোর সাহায্য না নিয়ে যদি আমরা চলি তাহলে হবে সেই পাখির বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ যেটা দিয়েছিলেন, যার একটা পাখাই সব, সে ঝড়ের মধ্যে কেঁপে উঠবে, ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে না।’…… তারচেয়ে বড় সত্য যেন আর কিছু নেই।

আর এই মনন এবং সংবেদনের সাহায্য যদি আমরা পেতে চাই, তাহলে এই দুই শিল্পী ও স্রষ্টার কাছে আমাদের প্রতিনিয়তই হাত পাততে হবে। জীবনকে যদি আমরা স্নিগ্ধতার ছোঁয়ায় পরিশুদ্ধ করতে চাই, তবে এই দুই শিল্পীর জীবন ও শিল্প আমাদের জন্যে এক বড় অনুপ্রেরণার জায়গা হতে পারে— আমাদের সংরাগে বা বিরাগে।

এই দুই মহান শিল্পীরই প্রয়াণ হয়েছে পরিণত বয়সে। তবুও কেন ব্যথা বাজে মনে! চেনাশোনা বলতে সাধারণত যা বোঝায় তা হয়তো ছিল না, কিন্তু তবুও তাদের সঙ্গে চেনাজানা যে ছিল। মনের অজান্তেই তাদের সৃষ্টিময়তার কতকিছুরই যে ছাপ রয়ে গেছে মনে, আজ তাদের প্রয়াণে যেন সেটুকু বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি হচ্ছে। আর তাইতো তাদের প্রয়াণ যেন খুব ব্যক্তিগত কিছু হারানোর বেদনা।

কে আর এমন করে বলতে পারে অলোকরঞ্জন ছাড়া— ‘আমরা যে একটা চূড়ান্ত অস্থিরতা ও আলোড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আমাদের সমস্ত মূল্যবোধগুলি দ্রবমান; সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি যদি একটা অমূর্ত অসীমের ধ্যানধারণা তৈরি করে, তার উদ্দেশ্যে কবিতা লিখি, তবে সেটা অবশ্যই আত্মপ্রতারণা হবে।’

এই দুই শিল্পীর প্রয়াণে সেই রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে বলতে হয়—

‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান—

তুমি জান নাই, তুমি জান নাই।

তুমি জান নাই তার মূল্যের পরিমাণ।’

সত্যিই, এই দুই মহান স্রষ্টা হয়তো কখনোই জানেননি বা আর জানবেনও না, তারা কতভাবে কতজনের জীবনকে যে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। আমাদের অনেকেরই বেড়ে উঠায় তাদের সরব উপস্থিতি ছিল, আর এখনো তাদের নানা সৃষ্টি আমাদের নানা সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে আছে, করোনার ক্রান্তিকালে তা যেন আরও বেশি করে অনুভব হচ্ছে। এ কথাটি হয়তো একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না, যদি বলি— যারাই জীবনে জীবন ঘষে আগুন পেতে চাবেন, জীবনকে খুঁজে পেতে তারাই তাদের সৃষ্টির দিকে ফিরে তাকাবেন।

Comments

The Daily Star  | English

Students, teachers declare 'shutdown' at JnU

JnU students have continued their blockade at the capital's Kakrail intersection for the second consecutive day

1h ago