চট্টগ্রাম

‘মেয়রের মৌখিক অনুমতিতে’ সরকারি জমিতে স্থাপনা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান  

চট্টগ্রাম
সড়কের জন্য রাখা জমিতে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিরাকল মাইলস ইন্টারন্যাশনাল। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সিইও চুক্তিতে সই করেননি, চসিক প্রকৌশল বিভাগ কিছুই জানে না, স্থাপনা নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনুমতিও নেওয়া হয়নি। কিন্তু এরপরও 'চসিকের অনুমতি' নিয়েই চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার থেকে মুরাদপুর সড়কের কাতালগঞ্জ পেট্রোল পাম্পের বিপরীতে পাঁচলাইশ এলাকায় সড়কের জন্য রাখা জমিতে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিরাকল মাইলস ইন্টারন্যাশনাল।   

চসিক সূত্র জানিয়েছে, 'সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য' ওই এলাকায় গেম জোন, দোকানপাট ও রেস্তোরাঁসহ বাণিজ্যিক স্থাপনাও গড়ে তোলা হবে।

পিডব্লিউডি চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ জানান, ওই জমির মালিক গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি)। পিডব্লিউডি যখন ১৯৫০ এর দশকে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা নির্মাণের প্রকল্পের পরিকল্পনা করছিল, তখন তারা রাস্তার জন্য জমি রেখেছিল। পরে আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয় এবং ষাটের দশকে রাস্তাও তৈরি করা হয়। রাস্তা তৈরির পর পাশে খোলা জায়গা রাখা হয়, যাতে ভবিষ্যতে রাস্তা আরও সম্প্রসারণ করা যায়। ১৯৮৮ সালে পিডব্লিউডি খোলা জায়গাসহ রাস্তাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে।

চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি হননি। চুক্তি সই না করে কীভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে তা নিয়ে তিনি বিস্মিত।

তিনি বলেন, 'যেহেতু চসিক এই জমির মালিক নয়, তাই আমি জমিতে স্থাপনা নির্মাণের জন্য গত অক্টোবরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি হইনি। আমি আশ্চর্য হয়েছি যে, চুক্তি না করে কীভাবে তারা স্থাপনা নির্মাণ করছে! সম্ভবত তারা মেয়রের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি পেয়েছে।'

মেয়রের মৌখিক অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করা বৈধ কি না- এই প্রশ্ন করা হলে তৌহিদুল নেতিবাচক জবাব দেন।

তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে আমি মেয়রের সঙ্গে কথা বলব।'

এমনকি চসিকের প্রকৌশল বিভাগও এই প্রকল্প সম্পর্কে কিছু জানে না।

চট্টগ্রাম
চলছে নির্মাণ কাজ। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

যোগাযোগ করা হলে চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) আবু সিদ্দিক বলেন, 'প্রকৌশল বিভাগ কিছু জানে না। প্রকল্প কে পেয়েছে, কত খরচ হচ্ছে, কে ডিজাইন করেছে সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। তবে মেয়রের পিএস আবুল হাসেম জানেন।'

বারবার চেষ্টা করেও ফোন না ধরায় এই ব্যাপারে আবুল হাসেমের বক্তব্য জানা যায়নি।

নগরীতে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি প্রদানকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকেও কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, 'পাঁচলাইশ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের জন্য চসিক কর্মকর্তারা আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নেননি বা আমাদের জানাননি। এটি আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। যেহেতু তারা সিডিএ থেকে অনুমতি নেয়নি, মনে হয় এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আমরা এ সম্পর্কে জানতে তাদের চিঠি দেবো।'   

তিনি বলেন, 'চসিক হলো নগরীর রাস্তা, ফুটপাত, নর্দমা ও খালের রক্ষণাবেক্ষণকারী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে তারা রক্ষকের নয়, বরং ভক্ষকের মতো কাজ করেছে।'

সরেজমিনে দেখা যায়, কাতালগঞ্জ পেট্রোল পাম্পের বিপরীতে ব্যস্ত সড়কের পাশে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম
ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

স্থাপনা নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য জমির দায়িত্ব পাওয়া বেসরকারি কোম্পানি মিরাকল মাইলস ইন্টারন্যাশনালের হেড অব অপারেশন্স ওমর ফারুক বলেন, তারা অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে ওয়াকওয়ে, প্যাসেঞ্জার শেড, পাবলিক টয়লেট, জিমনেসিয়াম, কিডস জোন, গেম জোন, বঙ্গবন্ধু কর্নার, লাইব্রেরি ও সাবেক মেয়রদের ম্যুরাল নির্মাণ করবেন।

তিনি বলেন, অক্টোবরে কাজ শুরু হয়েছে এবং ছয় মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠানই এই স্থাপনাগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। লাইব্রেরি, কিডস জোন এবং জিমনেসিয়ামে বিনামূল্যে সাধারণের প্রবেশাধিকার থাকবে। আর গেম জোন এবং পাবলিক টয়লেটের জন্য নামমাত্র অর্থ দিতে হবে।

সেখানে একটি রেস্তোরাঁ ও ওষুধের দোকানও নির্মাণ করা হবে বলে চসিক সূত্রে জানা গেছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা এই প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, অতীতে চসিক রাস্তা ও ফুটপাতের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও সেসবের অনেকগুলো শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। সড়কটি ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারণের জন্য খোলা জায়গা রাখা হয়েছে। এলাকায় স্থাপনা তৈরি হলে ভবিষ্যতে রাস্তা সম্প্রসারণ করা কঠিন হবে।

ফোরাম ফর প্ল্যানড চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'চসিক রাস্তার জমিতে কোনো কাঠামো নির্মাণ করতে পারে না। এটি আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। চকবাজার-মুরাদপুর সড়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সড়ক। এটি জিমনেসিয়াম ও কিডস জোন নির্মাণের জন্য সঠিক জায়গা নয়।'

`তাছাড়া রাস্তাটি ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। ভবিষ্যতে সড়কের সম্প্রসারণের জন্য রাখা হয়েছে এমন জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করা হলে পরে সড়ক সম্প্রসারণের সময় সমস্যা হবে', যোগ করেন তিনি। 

সুভাষ বড়ুয়া আরও বলেন, `চসিক কি জিমনেসিয়াম তৈরির জন্য অন্য কোনো জায়গা খুঁজে পায়নি? আসলে জিমনেসিয়াম এবং কিডস জোন তৈরি করা হচ্ছে শুধুই আইওয়াশ হিসেবে। পুরো প্রকল্পটি নগরীর বিভিন্ন সড়কে এমন অনেক সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পের মতো বাণিজ্যিক প্রকল্পে পরিণত হবে।'     

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'জমিটি খালি পড়েছিল। রাতে সেখানে মাদক সেবনসহ নানা অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালানো হতো। আমরা এটি উদ্ধার করে সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু করেছি।'

কোনো চুক্তিতে সই না করার বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, `জমিটি চসিকের মালিকানাধীন না হওয়ায় কোম্পানির সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারিনি।'

সিডিএ থেকে অনুমতি না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'চসিক কখনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য সিডিএর অনুমতি নেয়নি। আমাদের অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই।'

ভবিষ্যতে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য জমির প্রয়োজন হলে কী হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, 'প্রয়োজনে চসিক জমির দখল নিতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

10 ministries brace for budget cuts

The railway ministry, the power division, and the primary and mass education ministry will see the biggest chop.

11h ago