‘আমাদের ধারণাই ছিল না কী হতে যাচ্ছে’

ফেনীর লালপোল এলাকায় চার দিন পর মেয়ের সঙ্গে গতকাল দেখা হওয়ার পর কাঁদছেন সাইফুল ইসলাম ও তার মেয়ে সাদিয়া আক্তার। সাইফুল জানান, প্রবল বন্যায় এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তিনি তার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। ছবি: রয়টার্স

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী তুহিন রানা যখন গত সপ্তাহে জানতে পারেন বন্যার কথা তখনই তিনি নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়িতে তার বাবা-মা ও স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিরাপদে থাকার কথা জানান। তার স্ত্রী সদ্য মা হয়েছেন।

তুহিন ভেবেছিলেন উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় তার পরিবার জানেন কীভাবে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়।

কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। এরপরই জানতে পারেন বন্যার ভয়াবহতার কথা।

রওনা দেওয়ার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর গতকাল রোববার তিনি তার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। এমনিতে তার বাড়িতে যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার মতো। তবে এবার রাস্তায় পানি উঠে যাওয়া ও নৌকার অভাবে তার বাড়ি ফিরতে এতটা সময় লাগে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার বৃদ্ধ বাবা-মা আমাদের ছোট বাড়িটার বিছানার ওপর বসে আছেন। দুই দিন ধরে রান্না করা কোনো ভাবার তাদের পেটে পড়েনি। আমার স্ত্রী ও নবজাতক সন্তানকে প্রতিবেশীরা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গেছেন। ঘরের মধ্যে তখনো একফুট পানি।

'পাম্পের পানি অপরিস্কার থাকায় তারা অনিরাপদ পানিই খেয়েছেন। আমার খুবই অসহায় লাগছিল। তারা বুঝতেই পারেননি কী আসছিল,' বলেন তুহিন।  

এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা বাতাকান্দি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে তাদেরও পর্যাপ্ত খাবার, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা ছিল না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

কেউ কেউ রান্নার জন্য চুলা জ্বালিয়ে ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে তাদেরও টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পর অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সেই সাথে নৌকা না থাকায় খুব কম ত্রাণ সেখানে পৌঁছায়।

নোয়াখালী, ফেনী ও কুমিল্লা জেলার লাখ লাখ মানুষের মতো তুহিনের পরিবারের সদস্যরাও গত চার দিন অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছেন।

নোয়াখালীর আট উপজেলা এখনো বন্যাকবলিত। গতকাল মুষলধারে বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

এদিকে পানি কমলেও ফেনীর বেশ কয়েকটি প্রত্যন্ত উপজেলা সড়কপথে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনো পুরোপুরি সচল হয়নি এবং অনেক এলাকা এখনো বিদ্যুৎবিহীন।

স্থানীয়রা জানান, এখন খাবার ও পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে বন্যায় নোয়াখালী, কুমিল্লা ও রাঙামাটিতে তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এনিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। মৌলভীবাজারে নিখোঁজ আছেন দুই জন।

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মানুষ তাদের গ্রামে ফিরতে শুরু করেছেন।

বন্যায় অনেক ঘর ধসে পড়েছে এবং হাজারো মানুষ তাদের প্রায় সব জিনিসপত্র হারিয়েছেন। এছাড়াও খামার ও ঘরে থাকা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ১১টি জেলার ১০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখের বেশি।

অন্তত ৭৩টি উপজেলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়ায় ৪ লাখের বেশি মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

দুর্ভোগ-দুরবস্থা

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা ইউনুস সিকদার জানান, হাজার হাজার মানুষ খাবারের সংকটে ভুগছে।

তিনি বলেন, আমি আমার সমস্ত সঞ্চয় খাবার ও পানির জন্য খরচ করেছি। এখন আমরা নোংরা পানি খেতে বাধ্য হচ্ছি।'

যদিও পানি কমছে, ফেনী এবং কুমিল্লায় পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ রয়ে গেছে। ত্রাণ সামগ্রী অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছায়নি কারণ বন্যার রাস্তায় পানি ওঠায় ট্রাকগুলো আটকে ছিল আর নৌকা না থাকায় সেগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।   

কুমিল্লায় বন্যায় আটকে পড়া মানুষ খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে।

ফেনীর কয়েকটি স্থানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবির হেলিকপ্টার প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে।

বন্যায় মৎস্য খামার ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আনুমানিক ৪১১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

[নোয়াখালী থেকে আনোয়ারুল হায়দার এবং কুমিল্লা থেকে খালিদ বিন নজরুল এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন।]

Comments

The Daily Star  | English

Yunus returns home completing 4-day Japan tour

A flight of Singapore Airlines, carrying the CA landed at Hazrat Shahjalal International Airport at 12:15am on Sunday

2h ago