২০৩৫ সালে কর-জিডিপি সাড়ে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য রাজস্ব বোর্ডের

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নতুন প্রণীত ১০ বছর মেয়াদি রাজস্ব কৌশলের অংশ হিসেবে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য নিয়েছে।

গত রোববার প্রকাশিত মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস) অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী ও টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে।

রাজস্ব বোর্ড জানিয়েছে—বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আনার প্রস্তুতির পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে সহায়তা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে এই কর্মকৌশলটি এসেছে। সংস্থাটির চলমান চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে এই শর্ত দেওয়া আছে।

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাতকে বিশ্বের সর্বনিম্ন স্বীকার করে রাজস্ব বোর্ড এই লক্ষ্যমাত্রাকে 'উচ্চাভিলাষী' বলে অভিহিত করেছে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর যে চাহিদা তৈরি হবে তার তুলনায় এ লক্ষ্যকে 'অপর্যাপ্ত' বলে সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

এমএলটিআরএস'র প্রতিবেদনে রাজস্ব বোর্ড বলেছে, একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় সর্বোচ্চ করার দিকে সব শাখাকে কার্যকর করতে 'শক্তিশালী প্রেরণা' হিসেবে কাজ করতে পারে।

এতে বলা হয়েছে যে অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। বর্তমানে এটি জিডিপির প্রায় সাত দশমিক তিন শতাংশ।

রাজস্ব বোর্ড ২০৩২ সালের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের কম না করার লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করেছে। ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে তা সাড়ে ১০ শতাংশে নেওয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

তবে স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক দশকের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রাটি খুবই অপর্যাপ্ত।'

তার মতে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার পর অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা ও বিনিয়োগের চাহিদা মেটাতে আগামী ১০ বছরে লক্ষ্যমাত্রা কমপক্ষে ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত।

তিনি এমএলটিআরএস'র মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন। করদাতাদের পরিষেবা উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করার প্রশংসা করেছেন। তার ভাষ্য, 'করদাতারা যাতে হয়রানির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য কৌশলটি আরও এগিয়ে নিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'রাজস্ব বোর্ডের উচিত স্বচ্ছ ও স্বয়ংক্রিয় নিরীক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এটি করদাতা ও কর কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ কমাবে।'

এই কৌশলে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে মধ্যমেয়াদে ও ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বহু বছর ধরে এই অনুপাত সাত-আট শতাংশে আছে।

প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে। ২০১৮ সালে দেশটির প্রত্যক্ষ কর-জিডিপি অনুপাত ছিল দুই দশমিক ৬২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার গড় ছিল চার দশমিক ছয় শতাংশ। বৈশ্বিক গড় সাড়ে আট শতাংশ।

আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, কৌশলটি প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও সম্পত্তি, সম্পদ ও উত্তরাধিকারের ওপর কর আরোপের সুস্পষ্ট এজেন্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।

'সুষ্ঠু ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে বাংলাদেশ এসব খাতে সংস্কারে দেরি করতে পারবে না। সম্পত্তি, সম্পদ ও উত্তরাধিকার করের আধুনিকীকরণে স্পষ্ট ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা এমএলটিআরএস'র মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ছিল।'

বৈষম্য দ্রুত বাড়তে থাকায় এসব ক্ষেত্রে সংস্কার আগের তুলনায় বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।

তিনি আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস প্রক্রিয়ায় অটোমেশন ও এন্ড-টু-এন্ড ডিজিটালাইজেশনের ওপর জোর দেওয়াকে স্বাগত জানান। এটিকে 'সঠিক দিকে পদক্ষেপ' বলে অভিহিত করেন।

অটোমেশন দিয়ে বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে ঢাকা যাবে না মনে করেন তিনি।

অটোমেশনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো কাটাতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজস্ব বোর্ডে জনবল বাড়ানোকে সঠিক উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি গড়ে তোলা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হবে।'

লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কৌশলটির খসড়া তৈরির সঙ্গে জড়িত রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি উচ্চাভিলাষী হলেও বাস্তবসম্মত।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা অযৌক্তিক বা অসাধ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করিনি।'

তিনি জানান, রাজস্ব বোর্ড বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েছে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আগে আইএমএফের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আপাতদৃষ্টিতে সাড়ে ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা বড় মনে হলেও আগামী ১০ বছরে তারা কী ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছেন তাও বিবেচনায় রাখা জরুরি।'

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বব্যাংক আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক তিন শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। সরকার পূর্বাভাস দিয়েছে সাড়ে তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধির। উভয় পরিসংখ্যানই স্বাভাবিকের তুলনায় যথেষ্ট কম।

তিনি আরও বলেন, 'যদি আগামী বছরগুলোয় নিম্ন প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দেরি হয়, তাহলে সাড়ে ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও রাজস্ব আয়ের প্রকৃত পরিমাণ যতটা মনে হয় তত বড় নাও হতে পারে।'

তিনি মনে করেন, যেহেতু এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো সমন্বয়যোগ্য ও নিয়মিত পর্যালোচনা সাপেক্ষ, তাই ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে এখন গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশের প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, 'এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণের পরবর্তী তিন বছর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখনই চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনেক বাড়বে।'

সিপিডির গবেষণা পরিচালক আরও বলেন, 'ধারণা করছি—রাজস্ব আদায় অনেক বাড়াতে পারে এমন সংস্কারের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় না নিয়েই সাড়ে ১০ শতাংশ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।'

'আশা করি, আগামীতে সরকার কর আদায় ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে আনুষ্ঠানিক রূপ ও আরও বেশি মানুষকে করের আওতায় আনার প্রচেষ্টা জোরদার করবে। যদি তা হয়, তাহলে আমার বিশ্বাস, মধ্য মেয়াদেই আমরা বর্তমান লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারবো।'

প্রতিবেদনে রিটার্ন দাখিলের হার বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া, ২০৩০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত করদাতাদের কাছ থেকে ভ্যাট রিটার্ন শতভাগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজস্ব বোর্ড।

 

Comments

The Daily Star  | English

Explosions rock Indian Kashmir

Sirens ring out in Jammu, projectiles in night sky; Islamabad says Indian drones earlier entered its airspace

9h ago